জানলা বন্ধ
 


রবীন্দ্রসঙ্গীত চরিতাভিধান



এই সাইটে রবীন্দ্রসঙ্গীতের তথ্য ও আলোচনায় অনেক লোকের নাম ও উদ্ধৃতি ব্যবহার করা হয়েছে। কৌতূহলী পাঠকদের সুবিধার্থে সেই মানুষদের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি বর্ণানুক্রমিক ভাবে দেওয়া হোলো। মাত্র রবীন্দ্রনাথের সঙ্গীতজগতের পরিপ্রেক্ষিতে তাঁদের পরিচয় লিপিবদ্ধ করা হয়েছে, এগুলি পূর্ণাঙ্গ পরিচিতি নয়। আরো কিছুকাল এই তালিকার কলেবর বৃদ্ধি হতে থাকবে মনে হয়।

এই তথ্যের বহু উত্স। তার মধ্যে সমীর সেনগুপ্তের "গানের পিছনে রবীন্দ্রনাথ" (প্যাপিরাস, ২০০৮) ও "সংসদ বাঙালী চরিতাভিধান" (সাহিত্য সংসদ, ১৯৭৬) প্রধান।

অক্ষয়কুমার মজুমদার:   'বড়ো অক্ষয়বাবু', ঠাকুর পরিবারের আত্মীয়, সঙ্গীত ও নাট্যানুরাগী।

অক্ষয়চন্দ্র চৌধুরী (১৮৫০-৯৮):   হাওড়া আন্দুলের অধিবাসী। জ্যোতিরিন্দ্রনাথের সহপাঠী, সাহিত্যিক, ঠাকুর পরিবারের সঙ্গে বিশেষ হৃদ্যতা ছিল। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর এক গভীর সাহিত্যসম্পর্ক গড়ে ওঠে।

অঘোরনাথ চট্টোপাধ্যায় (১৮৫১-১৯২০):   অধ্যাপক, শিক্ষাবিদ, হায়দ্রাবাদ নিজাম রাজ্যে শিক্ষাসংস্কারের কাজ করতেন। সরোজিনী নাইডুর পিতা।

অজিতকুমার চক্রবর্তী (১৮৮৬-১৯১৮):   শান্তিনিকেতনের প্রথম যুগের শিক্ষক, সাহিত্যচর্চা, অভিনয় ইত্যাদিতে উত্সাহী ছিলেন, রবীন্দ্রসঙ্গীত-অনুরাগীদের প্রথম শ্রেণীতেই থাকতেন। রবীন্দ্রনাথ-পরিচালিত বহু অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছিলেন। রবীন্দ্রসাহিত্যের উপর বেশ কয়েকটি বইও লিখেছিলেন।

অতুলচন্দ্র গুপ্ত (১৮৮৪-১৯৬১):   সাহিত্যিক, ব্যবহারজীবী, 'সবুজপত্র'-গোষ্ঠীর অন্যতম লেখক।

অতুলপ্রসাদ সেন (১৮৭১-১৯৩৪):   কবি ও গীতিকার। লক্ষ্ণৌ-প্রবাসী আইনজীবী। প্রায় ২০০ গান লিখেছেন (সবগুলির সুর পাওয়া যায় না), রবীন্দ্রনাথের মতো রাগসঙ্গীত ভেঙেও কিছু গান আছে। বাংলা গানের সুরে এক নতুন রীতির প্রবর্তক। রবীন্দ্রঅনুরাগী ও স্নেহধন্য। গীতসংকলন "গীতিগুঞ্জ"।

অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৯১-১৯৫১):   মহর্ষির তৃতীয় ভ্রাতুষ্পুত্র গুণেন্দ্রনাথের পুত্র। বাংলার চিত্রশিল্পে যুগান্তর আনেন। রবীন্দ্রনাথের খুব কাছের লোক ছিলেন, বহু রবীন্দ্র-নাটকে অভিনয় করেছেন, মঞ্চসজ্জাতেও তাঁর অবদান ছিলো প্রভূত। বহু বইয়ের লেখক, তার মধ্যে স্মৃতিলিপিগুলিতে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গীতসৃষ্টি ও চিন্তা সম্বন্ধে অনেক তথ্য পাওয়া যায়।

অভিজ্ঞা [ঠাকুর] চট্টোপাধ্যায় (১৮৭৪-৯৫):   হেমেন্দ্রনাথ ঠাকুরের তৃতীয়া কন্যা। সুকণ্ঠের অধিকারিণী ছিলেন, 'কালমৃগয়া' ও 'মায়ার খেলা'-র প্রথম অভিনয়ে অংশ নিয়েছিলেন, তাঁর গানের কথা 'ছিন্নপত্র'-তে কয়েক জায়গায় লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ। তাঁর অকালমৃত্যুর পর রবীন্দ্রনাথ কয়েকটি কবিতা লেখেন তাঁর স্মৃতিতে।

অমল হোম (১৮৯৩-১৯৭৫):   সাংবাদিক, সম্পাদক, সমালোচক ও লেখক, রবীন্দ্রনাথের বিশেষ স্নেহপাত্র।  The Calcutta Municipal Gazette এর দুটি বিশেষ সংখ্যা -- একটি রবীন্দ্রনাথের ৭০ বত্সর পূর্তি উপলক্ষ্যে এবং অন্যটি রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর রবীন্দ্রস্মরণসংখ্যা-- সম্পাদনা ও প্রকাশে অসাধারণ নৈপুণ্যের পরিচয় দেন, আজও তা সম্পাদনার আদর্শ হিসেবে গণিত হয়। রবীন্দ্রকৃতির অনবদ্য সঙ্কলন সংগ্রহ ছিল তাঁর।

অমলা দাশ (১৮৭৩-১৯২০):   দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের ভগ্নী। প্রখ্যাত রবীন্দ্রসঙ্গীত গায়িকা। একসময় রেকর্ড মারফৎ রবীন্দ্রসঙ্গীত-প্রচারে রবীন্দ্রনাথের অনুমোদন নিয়ে অদ্বিতীয়া। রেকর্ডে নাম থাকত 'মিস দাস, এ্যামেচার'। ঠাকুর পরিবারের সঙ্গে অতি ঘনিষ্ঠ যোগ ছিল, বিশেষত কবিপত্নী মৃণালিনী দেবীর সঙ্গে তাঁর বিশেষ সখ্যতা নিয়ে কবি গানও রচনা করেছেন।

অমিতা সেন (১৯১২-২০০৫):   আচার্য ক্ষিতিমোহন সেনের কন্যা, অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের জননী। শান্তিনিকেতনেই আজীবন কাটিয়েছেন, তারই স্মৃতিচারণ করে লেখা "শান্তিনিকেতনে আশ্রমকন্যা" তাঁর বিখ্যাত বই। সুলেখিকা ছিলেন, রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টির প্রায় সব দিক নিয়েই তাঁর লেখা সংবাদ ও আলোচনা মূল্যবান দলিল।

অমিতা সেন (খুকু) (১৯১৪-৪০):   শান্তিনিকেতনে পাঠভবন, পরে শিক্ষাভবনে সংস্কৃত সাহিত্য নিয়ে স্নাতক হন। রবীন্দ্রনাথের বিশেষ স্নেহধন্যা এবং প্রবাদপ্রতিম গায়িকা, গান শিখেছেন রবীন্দ্রনাথ এবং দিনেন্দ্রনাথের কাছে, গান শিখিয়েছেন শৈলজারঞ্জন প্রমুখ পরবর্তীকালের দিকপালেদের। রবীন্দ্রনাথ চেয়েছিলেন, দিনেন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর তিনিই সঙ্গীতভবনের দায়িত্ব নেন। কিন্তু অমিতা কলকাতায় শিক্ষকতা করতে শুরু করেন। তারপর যদিও রবীন্দ্রনাথের অনুরোধে শান্তিনিকেতনে আসেন, কিন্তু কোনো কারণে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে মতান্তর ঘটায় শান্তিনিকেতন ত্যাগ করে চলে যান। মাত্র ২৬ বছর বয়সে মৃত্যু হয়। ছটি রেকর্ডে বারোটি রবীন্দ্রসঙ্গীত ধৃত আছে। রবীন্দ্রনাথের বড়ো কবিতায় এঁরই কণ্ঠে সুরারোপের উদ্যোগ করেছিলেন কবি। উপযুক্ত ব্যবস্থার অভাবে সে সব লুপ্ত হয়ে গেছে।

অমিয়া (রায়) ঠাকুর:  হেমেন্দ্রনাথ ঠাকুরের জ্যেষ্ঠপুত্র হিতেন্দ্রনাথের পুত্র হৃদিন্দ্রনাথের সুগায়িকা পত্নী। 'মায়ার খেলা' ও 'বাল্মীকি প্রতিভা'য় গানে ও অভিনয়ে প্রশংসা পেয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথের গানের প্রথম যুগের খ্যাতনাম্নী শিল্পী।

অরুণেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬৩-১৯২৯):   দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের দ্বিতীয় পুত্র।

অসিতকুমার হালদার (১৮৯০-১৯৬৪):   রবীন্দ্রনাথের দিদি শরত্কুমারীর কন্যা সুপ্রভার পুত্র, রবীন্দ্রনাথের সম্পর্কে নাতি হলেন। শান্তিনিকেতন ব্রহ্মচর্যাশ্রমের আদি ছাত্র, পরে অবনীন্দ্রনাথের কাছে ছবি আঁকা শেখেন ও 'বেঙ্গল স্কুল'-এর অন্যতম শিল্পী বলে গণ্য হন। লক্ষ্ণৌ সরকারি শিল্প মহাবিদ্যালযের অধ্যক্ষ ছিলেন। কিছু রবীন্দ্র-অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছিলেন, তাঁর আঁকা ছবি রবীন্দ্রনাথের কোনো কোনো গানের উত্স বলে জানা যায়।

আর্নল্ড এড্রিয়ান বাকে (১৮৯৯-১৯৬৩):   হল্যাণ্ডের কার্ন ইন্স্টিটিউট থেকে বৃত্তি নিয়ে সঙ্গীতের উপর গবেষণা করার জন্য ১৯২৫ সালে সস্ত্রীক শান্তিনিকেতন সঙ্গীতভবনে আসেন। কবির বালি ও যবদ্বীপ ভ্রমণের সঙ্গী। ফিল্‌প স্টার্নের সহযোগিতায় সৃষ্ট Twentysix Songs of Rabindranath Tagore বিলেতি স্বরলিপি-সহ একটি প্রামাণ্য বই, এছাড়াও তিনি সঙ্গীতের উপর অনেক বই লিখেছেন। রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর কাজের ওপর ডাচ ভাষায় কয়েকটি বইও আছে। ১৯৪৯ সাল থেকে আমৃত্যু লণ্ডন ইউনিভার্সিটিতে ভারতীয় সঙ্গীতের অধ্যাপক ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁদের 'আরুণি' ও 'করুণা' বলে ডাকতেন মাঝে মাঝে।

ইন্দিরা দেবী চৌধুরানী (১৮৭৩-১৯৬০):   সত্যেন্দ্রনাথ ও জ্ঞানদানন্দিনী দেবীর কন্যা, প্রমথ চৌধুরীর পত্নী, ডাকনাম ছিল বিবি। রবীন্দ্রনাথের খুব কাছের মানুষ ছিলেন, 'ছিন্নপত্রাবলী' ইন্দিরাকেই লেখা। গানে-বাজনায়, দেশী-বিদেশী, সব রকম সঙ্গীতচর্চায় অসাধারণ পারদর্শিনী, রবীন্দ্রসঙ্গীতের কথা, সুর, স্বরলিপি-- সব বিষয়েই তাঁর জ্ঞান ও মত শিরোধার্য গণ্য করা হতো। শান্তিনিকেতনে সঙ্গীতভবনে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত ছিলেন বহুদিন, একসময় বিশ্বভারতীর উপাচার্যও ছিলেন। সুলেখিকা ও সাহিত্যানুরাগী, "রবীন্দ্রসঙ্গীতের ত্রিবেণীসঙ্গম" ও "স্মৃতিসম্পুট" প্রামাণ্য গ্রন্থ।

ইন্দুলেখা ঘোষ:   আদিতে বারাণসীর বাসিন্দা, সুকণ্ঠের অধিকারিণী ছিলেন। দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে যোগাযোগ হয় যখন দিনেন্দ্রনাথ কাশী বেড়াতে যান। তাঁর গানে মুগ্ধ দিনেন্দ্রনাথের অনুরোধে, রবীন্দ্রনাথের আহবানে শান্তিনিকেতনে আসেন ১৯৩৪ সালে (যদিও দিনেন্দ্রনাথ তার আগে শান্তিনিকেতন ছেড়ে চলে গেছেন)। শান্তিনিকেতনের অনুষ্ঠানে সমবেতকণ্ঠে গানের রেওয়াজ ছিল, ইন্দুলেখাই প্রথম একক কণ্ঠে গান করার সুযোগ ও সম্মান পান। গান্ধীজীর শিষ্যা, বিবাহ করেননি, আজীবন গান্ধীজির আদর্শে বিলাসবর্জিত জীবনযাপন করে গেছেন। কয়েকটি রেকর্ড করেছিলেন, আজ তা দুর্লভ।

উষাবতী ঠাকুর:   দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কনিষ্ঠা কন্যা।

কাদম্বরী দেবী (গঙ্গোপাধ্যায়) (১৮৫৯-১৮৮৪):   জ্যোতিরিন্দ্রনাথের পত্নী, রবীন্দ্রনাথের 'নতুন বৌঠান'। ন'বছর বয়সে বিয়ের পর ঠাকুরবাড়ি আসেন, মাত্র ষোলো বছর বিবাহিত জীবনের পর নিঃসন্তান অবস্থায় অকালমৃত্যু। কিন্তু এই সময়ের মধ্যেই রবীন্দ্রনাথের জীবনে বিশেষ স্থান করে নিয়েছিলেন, রবীন্দ্রনাথের পরবর্তী জীবনে তার দূরপ্রসারী প্রভাব অনস্বীকার্য। রবীন্দ্রনাথ তাঁকে সাতটি বই উত্সর্গ করেছিলেন। তাছাড়া গদ্যে, পদ্যে, গানে. ছবিতে-- রবীন্দ্রনাথের সব কৃতিতে তাঁর ছায়া পড়েছে বলা যায় ও হয়।

কালিদাস নাগ (১৮৯১-১৯৬৬):   রবীন্দ্রনাথের অতি ঘনিষ্ঠ বন্ধু প্রবাসী-সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের কন্যা শান্তার স্বামী। ঐতিহাসিক, সঙ্গীতজ্ঞ। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল, একসঙ্গে প্রাচ্য ও চীনভ্রমণে গিয়েছিলেন। সেই ভ্রমণকথা, ডায়েরি ও পরস্পরের মধ্যে লেখা পত্রাবলী থেকে রবীন্দ্রনাথের গান নিয়ে অনেক তথ্য পাওয়া যায়।

ক্ষিতিমোহন সেন (১৮৮০-১৯৬০):   ১৯০৮ সালে রবীন্দ্রনাথের আহবানে শান্তিনিকেতনে আসেন এবং রবীন্দ্রনাথের বিশেষ বন্ধু ও সহকারী হয়ে ওঠেন। নানা শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত। প্রবন্ধ, স্মৃতিকথা, চিঠিপত্র অগণ্য-- তাদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গীত নিয়ে বহু তথ্য পাওয়া যায়। অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের মাতামহ।

ক্ষিতীশপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়:   সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কন্যা মঞ্জুশ্রীর স্বামী। রবীন্দ্রনাথের কিছু নাটকে অভিনয় করেছেন।

গগন হরকরা (মণ্ডল):   শিলাইদহের ডাকহরকরা, গীত রচনা করতেন ও সুর দিতেন। এঁরই রচিত "আমি কোথায় পাব তারে" গানটি ভেঙে রবীন্দ্রনাথ "আমার সোনার বাংলা" রচনা করেন, সেটি আজ বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত।

গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬৭-১৯৩৮):   মহর্ষির ভ্রাতুষ্পুত্র গুণেন্দ্রনাথের জ্যেষ্ঠ পুত্র, অবনীন্দ্রনাথের বড়ো ভাই, অসাধারণ চিত্রশিল্পী হিসেবে বিখ্যাত। রবীন্দ্রনাথের বহু নাটকে অভিনয় করেছেন, এছাড়া মঞ্চসজ্জাতেও তাঁর ভূমিকা বহুবিশ্রুত।

গণেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৪১-৬৯):  মহর্ষির ভাই গিরীন্দ্রনাথের পুত্র। সাহিত্য, শিল্প, নাটকরচনা ও অভিনয় নিয়ে বিশেষ উদ্যোগী পুরুষ ছিলেন।

গুরুদাস ঠাকুর:   শৌরীন্দ্রমোহনের পৌত্র। সঙ্গীতজ্ঞ।

গৌরী (বসু) ভঞ্জ:   নন্দলাল বসুর জ্যেষ্ঠা কন্যা। প্রথম বাঙালী গৃহস্থকন্যা যিনি সাধারণ মঞ্চে নাচেন, রবীন্দ্রনাথের "নটীর পূজা" নৃত্যনাট্যে শ্রীমতীর ভূমিকায়। এ নিয়ে রক্ষণশীলরা অনেক প্রতিকূল সমালোচনা করে। তিনি পরেও রবীন্দ্রনাথের বহু মঞ্চানুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছিলেন।

চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৭৭-১৯৩৮):   ঢাকা ও পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অধ্যাপক। রবীন্দ্রনাথের বিশেষ স্নেহধন্য। এঁর লেখা "রবিরশ্মি" বইটি রবীন্দ্রনাথের কবিতার ভাষ্য হিসেবে অগ্রপথিক বলা যেতে পারে। স্মৃতিকথা থেকে রবীন্দ্রনাথের বেশ কয়েকটি গানের বিষয়ে তথ্য পাওয়া যায়।

চিত্রলেখা সিদ্ধান্ত (১৮৯৮-১৯৭৪):   নির্মলকুমার সিদ্ধান্তের পত্নী, 'ছোটো ঝুনু' নামে পরিচিতা ছিলেন। রবীন্দ্রসঙ্গীতের সুগায়িকা বলে খ্যাতি ছিল, বহু অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথের গান প্রথমবার গেয়েছেন।

জগদিন্দ্রনাথ রায় (১৮৬৮-১৯২৬):   নাটোরের মহারাজা, ঠাকুর পরিবারের সঙ্গে বিশেষ ঘনিষ্ঠতা ছিল। সঙ্গীতজ্ঞ, বিশেষত পাখোয়াজ-বাদনে বিশেষ পারদর্শী ছিলেন। প্রচলিত রীতি অনুযায়ী খ্যাত ছিলেন "নাটোর" বলে ।

জগদীশচন্দ্র বসু (১৮৫৮-১৯৩৭):   খ্যাতিমান জীববিজ্ঞানী, রবীন্দ্রনাথের পারিবারিক বন্ধু, তাঁর বহু সৃষ্টির প্রথম সাক্ষী। তাঁরই 'বসু বিজ্ঞান মন্দির'-এর ভিত্তি স্থাপনকালে রবীন্দ্রনাথ 'মাতৃমন্দির পুণ্য অঙ্গন' গানটি রচনা করেন।

জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৪৯-১৯২৫):   মহর্ষির পঞ্চম পুত্র, রবীন্দ্রনাথের 'নতুনদাদা'। স্ত্রী কাদম্বরী দেবী, 'নতুন বৌঠান'। কৈশোর ও প্রথম যৌবনে রবীন্দ্রনাথের চরিত্রগঠনে এই দম্পতীর অবদান কবি স্বয়ং মুক্ত কণ্ঠে স্বীকার করেছেন-- বিশেষত সঙ্গীতপ্রতিভার বিকাশে। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী-- সঙ্গীত, চিত্রাঙ্কন, এককালের সফল নাট্যকার। অসংখ্য হাসির গান আর ব্রহ্মসঙ্গীত রচনা করেছেন। দুই ভাইয়ের সুর গঠনে বেশ মিল দেখা যায়-- কিছু গান কোন ভাইয়ের রচনা তা ঠিক করতে মুস্কিল হয় সময় সময়। আকারমাত্রিক স্বরলিপির উদ্ভাবক ও প্রচারক, রবীন্দ্রনাথের কিছু গানের স্বরলিপিকার। তাঁর প্রকাশিত "বীণাবাদিনী" পত্রিকাকে বাংলা ভাষার প্রথম সঙ্গীতবিষয়ক পত্রিকা বলা হয়। স্ত্রীর অকালমৃত্যুর পর আর বিবাহ করেননি। বড়ো ভাই সত্যেন্দ্রনাথের পরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ছিলেন, নিঃসন্তান অবস্থায় শেষজীবনে রাঁচির মোরাবাদী পাহাড়ে তাঁদের কাছাকাছি থাকতেন। সেখানেই মারা যান।

জ্যোত্স্নানাথ ঘোষাল (১৮৭০-১৯৬২):   জানকীনাথ ঘোষাল ও স্বর্ণকুমারী দেবীর পুত্র। আইসিএস, বোম্বাই অঞ্চলে কাজ করতেন।

দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৮২-১৯৩৫):   দ্বিজেন্দ্রনাথের জ্যেষ্ঠ পুত্র দ্বিপেন্দ্রনাথ ও তাঁর পত্নী সুশীলা দেবীর জ্যেষ্ঠ পুত্র, সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের নাতি (দ্বারকানাথের বংশে জ্যেষ্ঠপুত্রদের নামের দ-আদ্যক্ষর লক্ষ্যণীয়)। জন্মকালে নাম ছিল দীনেন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথের আগ্রহে পরে দিনেন্দ্রনাথে-এ পরিবর্তিত হয়। বিশিষ্ট সঙ্গীতজ্ঞ, প্রথম শ্রেণীর গায়ক এবং অভিনেতা। ইংল্যাণ্ডে ব্যারিস্টারি পড়তে যান এবং ইউরোপীয় সঙ্গীতবিদ্যাতেও পারদর্শী হন। গানের ব্যাপারে অসাধারণ স্মৃতিশক্তির অধিকারী ছিলেন, গান দুয়েকবার শুনলেই গলায় তুলে নিতে পারতেন এবং ভুলতেন না। শান্তিনিকেতন বিদ্যালয় স্থাপিত হবার পর তিনি সেখানে গিয়ে থাকতেন। রবীন্দ্রনাথ নতুন গান রচনা করেই দিনেন্দ্রনাথকে সুরটি শিখিয়ে দিতেন। দিনেন্দ্রনাথ অন্যদের সে গান শেখাতেন এবং পরে কোনো সময় স্বরলিপিবদ্ধ করে রাখতেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁকে 'গানের ভাণ্ডারী' পদবী দেন। রবীন্দ্রনাথের প্রায় সাতশো গানের স্বরলিপি তাঁরই করা, তাছাড়া শান্তিনিকেতনের সেকালের প্রায় সব অনুষ্ঠানেই সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন। বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠার পর রথীন্দ্রনাথের সঙ্গে নানা মতবিরোধের কারণে তিনি শেষপর্যন্ত শান্তিনিকেতন ছেড়ে কলকাতায় চলে আসেন ১৯৩৪ সালে ও ভগ্নহৃদয়ে মারা যান পরের বছর। স্ত্রী কমলা দেবী, কমল বৌঠান নামে পরিচিতা ছিলেন।

ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় (১৮৯৪-১৯৬১):   লক্ষ্ণৌবাসী সাহিত্যিক, অধ্যাপক, সঙ্গীতবেত্তা। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সঙ্গীত সম্পর্কে আলোচনা, বিশেষত পত্রবিনিময় করেছেন, তাতে সঙ্গীত সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের চিন্তার প্রামাণ্য বিবরণ পাওয়া যায়।

নন্দলাল বসু (১৮৮৩-১৯৬৬):   প্রথিতযশা চিত্রশিল্পী, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছাত্র। ১৯২০ সাল থেকে শান্তিনিকেতনে কলাভবন চালনার দায়িত্ব নিয়ে সেখানেই বসবাস করেন। রবীন্দ্রনাথের চীন, জাপান ইত্যাদি ভ্রমণে সঙ্গী ছিলেন। স্ত্রী সুধীরা দেবী। কন্যা গৌরী (পরে ভঞ্জ) রবীন্দ্রনাথের "নটীর পূজা" নাটকে অভিনয় করেন, গৃহস্থকন্যাদের এই প্রথম সাধারণ রঙ্গমঞ্চে আত্মপ্রকাশ।

নির্মলকুমারী "রানী" মহলানবিশ (১৯০০-১৯৮১):   প্রখ্যাত ব্রাহ্ম আচার্য হেরম্ব মৈত্রের কন্যা ও পরিসংখ্যানবিদ প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশের পত্নী। উভয়েই রবীন্দ্রনাথের কবির স্নেহভাজন ছিলেন, অনেকবার কবি এঁদের কাছে আলিপুরে বা বরানগরে গিয়ে থেকেছেন। কবির সঙ্গে দুবার ভ্রমণে যান, তার অনেক তথ্য বিধৃত করেছেন দুটি বইতে-- "কবির সঙ্গে ইউরোপে" ও "কবির সঙ্গে দাক্ষিণাত্যে"।

নীতীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬৭-১৯০১)   দ্বিজেন্দ্রনাথের তৃতীয় পুত্র, রবীন্দ্রনাথের অতি প্রিয়। জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির সব অনুষ্ঠান সুচারু রূপে সজ্জিত করার দায়িত্ব পালন করেছেন আমৃত্যু। নীতীন্দ্র-বলেন্দ্র-সুরেন্দ্র-- এই তিন ভ্রাতুষ্পুত্র রবীন্দ্রনাথের খুব প্রিয়পাত্র ছিলেন।

প্রতিভা দেবী (১৮৬৬-১৯২২):   হেমেন্দ্রনাথের [মহর্ষির তৃতীয় পুত্র] জ্যেষ্ঠা কন্যা, সঙ্গীতে বিশেষ পারদর্শিনী ছিলেন। রবীন্দ্রনাথের বহু সঙ্গীত ও নাটক প্রয়াসে তিনি প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করতেন বলে জানা যায়।

প্রতিভা বসু (১৯১৫-২০০৭):   বিখ্যাত লেখিকা, সাহিত্যিক বুদ্ধদেব বসুর পত্নী। প্রথম যৌবনে (প্রাক্‌বিবাহ পরিচিতি ছিল রাণু সোম বলে) খ্যাতনাম্নী গায়িকা ছিলেন, রবীন্দ্রনাথের বেশ কিছু গান রেকর্ড করেন। কবি ও কবি পরিবারের সঙ্গে বহুদিনের ঘনিষ্ঠতা।

প্রমোদকুমার ঠাকুর (১৮৭৩-১৮৯৭):   শৌরীন্দ্রমোহন ঠাকুরের পুত্র, সঙ্গীতজ্ঞ ও সঙ্গীতরচয়িতা হিসেবে নাম কিনেছিলেন।

প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ (১৮৯৩-১৯৭২):   বিখ্যাত পদার্থবিদ অধ্যাপক ও ভারতে সংখ্যাতত্ব প্রচারের পথিকৃৎ, ইণ্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইন্স্টিটিউটের জনক। ভারত সরকারের প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার প্রধান উদ্ভাবক। ব্রাহ্মসমাজের সূত্রে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে পরিচয় পরে গভীর অন্তরঙ্গতায় পরিণত হয়। ১৯২১-৩১ সাল পর্যন্ত শান্তিনিকেতনে কবির কর্মসচিব ছিলেন। কবি তাঁর আলিপুর ও বরানগর, দুই বাড়িতেই বহুবার আতিথ্য গ্রহণ করেছেন। কবির বহু সৃষ্টিকর্মের সাক্ষী। পত্নী নির্মলকুমারী মহলানবিশ রবীন্দ্রনাথের বিশেষ প্রিয়পাত্রী ছিলেন।

প্রিয়নাথ সেন (১৮৫৪-১৯১৬):   রবীন্দ্রনাথের প্রথম যৌবনের অতি নিকটের বন্ধু। সাহিত্যরসিক।

বাণী চট্টোপাধ্যায়:   হেমেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পুত্র ক্ষিতীন্দ্রনাথের কন্যা। সুগায়িকা ও সঙ্গীতশাস্ত্রে পারদর্শিনী। রবীন্দ্রনাথের গানের ইংরেজি অনুবাদ করেছেন।

বিধুশেখর শাস্ত্রী (১৮৭৯-১৯৫৮):   মহামহোপাধ্যায়। কাশীতে পড়াশোনা করে শাস্ত্রী উপাধি লাভের পর ১৯০৫ সালে শান্তিনিকেতন বিদ্যালয়ে যোগ দিয়ে একটানা ত্রিশ বছর বিশ্বভারতীতে অধ্যাপনা করেন। রবীন্দ্রনাথের অনুরোধে বৌদ্ধশাস্ত্র ও পালিভাষার চর্চা করেন, সংস্কৃত ভাষাতেও অসাধারণ পাণ্ডিত্য ছিল। প্রায় বিশটির কাছাকাছি বইয়ের লেখক বা সম্পাদক। রবীন্দ্রনাথের অন্তরঙ্গগোষ্ঠীর অন্যতম।

বিষ্ণু চক্রবর্তী (১৮০৪-১৯০০): আদি ব্রাহ্ম সমাজের গায়ক ও ঠাকুর পরিবারের সঙ্গীতশিক্ষক, রবীন্দ্রনাথের প্রথম সঙ্গীতগুরু। রামমোহন রায়ের সময় (১৮২৮ সাল) থেকে একাদিক্রমে ১৮৮৩ সাল পর্যন্ত তিনি ব্রাহ্ম সমাজের গায়ক ছিলেন, সঙ্গীতশাস্ত্রে অগাধ পাণ্ডিত্য। ধ্রুপদ-খেয়াল আদি গানই তিনি বেশী গাইতেন, নিজে অনেক হিন্দি ও বাংলা গান রচনা করেছেন, কলকাতার রঙ্গমঞ্চে নেপথ্য গায়ক ছিলেন। গান শেখার অভিজ্ঞতা থেকে রবীন্দ্রনাথ লিখছেন: "একজন বড় ধ্রুপদ ও খেয়াল গায়কের পক্ষে কীভাবে সাধারণ চলতি গ্রাম্য ভাষার ছড়াকে মার্গসঙ্গীতপন্থী বৃদ্ধ গায়ক বিনা দ্বিধায় গাহিয়া শিখাইয়াছেন তাহা ভাবিয়া বিস্মিত হইতে হয়।"  

ভীমরাও শাস্ত্রী (হসুরকর):   মহারাষ্ট্রীয় ব্রাহ্মণ, গোয়ালিয়র থেকে সঙ্গীতশাস্ত্রে শাস্ত্রী উপাধি পেয়ে ১৯১৪ সালে শান্তিনিকেতনে যোগ দেন উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের শিক্ষক হিসাবে। পরে সঙ্গীতভবনের অধ্যক্ষও হয়েছিলেন। বাংলা ভাষা শেখেন ও তারপর রবীন্দ্রনাথের গান প্রচারে ব্রতী হন। তাঁর কাছ থেকে শুনে রবীন্দ্রনাথ অনেক হিন্দি রাগসঙ্গীত ভেঙেছিলেন। সংস্কৃতজ্ঞ ছিলেন, শান্তিনিকেতনে সংস্কৃত নাটক মঞ্চস্থ করেছেন। রবীন্দ্রনাথের কিছু গানের মূল স্বরলিপি করেছেন, তাঁর প্রকাশিত সঙ্গীত গীতাঞ্জলি রবীন্দ্রনাথের কিছু গানের দেবনাগরী হরফে করা স্বরলিপি, অবাঙালিদের মধ্যে রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রচারে বিশেষ সহায়ক। বহুদিন শিক্ষকতা করা পর অর্থাভাবের অজুহাতে তাঁকে একদিন শান্তিনিকেতন থেকে বিদায় দেওয়া হয়।

মঞ্জুশ্রী চট্টোপাধ্যায় (১৯০৭-৮০):   সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কন্যা, ক্ষিতীশপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের স্ত্রী।

মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায় (১৮৮৮-১৯২৯):   সাহিত্যিক, সম্পাদক। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জামাতা। দীর্ঘকাল (১৩২২-৩০) ভারতী পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন।

মনীষা দেবী:   হেমেন্দ্রনাথ ঠাকুরের চতুর্থ কন্যা। পাশ্চাত্য যন্ত্রবাদনে পারদর্শিনী ছিলেন।

মৈত্রেয়ী দেবী (১৯১৪-১৯৯০):   রবীন্দ্রনাথের অন্তরঙ্গ বিশিষ্ট দার্শনিক সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্তের কন্যা। পিতৃসূত্রে ছেলেবেলা থেকেই কবির কাছাকাছি এসেছিলেন। পরে রবীন্দ্রনাথ মংপুতে তাঁর বাড়িতে বেশ কয়েকবার অবকাশ কাটিয়ে যান। সেই সময়ের স্মৃতিকথা "মংপুতে রবীন্দ্রনাথ", এছাড়া "স্বর্গের কাছাকাছি" ও "রবীন্দ্রনাথ: গৃহে ও বিশ্বে" , এই বইগুলিতে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গীতের অনেক তথ্য পাওয়া যায়। সুলেখিকা ছিলেন, পুরস্কারপ্রাপ্ত "ন হন্যতে" বইটিতেও কবির কথা বলা আছে।

রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৮৮-১৯৬১):   রবীন্দ্রনাথের জ্যেষ্ঠ পুত্র, স্ত্রী প্রতিমা দেবী, নিঃসন্তান, নন্দিনী নামে এক পালিতা কন্যা ছিল। রবীন্দ্রনাথের সর্বকর্মের সঙ্গী ছিলেন। স্মৃতিকথাতে কবি ও তাঁর গান সম্বন্ধে তথ্য পাওয়া যায়। কবির বর্তমানেই বিশ্বভারতী পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েছিলেন, পরে উপাচার্যও হন।

রানী চন্দ (১৯১২-১৯৬৭):   চিত্রশিল্পী মুকুল দের ছোট বোন, রবীন্দ্রনাথ তাঁকে কলকাতা থেকে এনে শান্তিনিকেতনে কলাভবনে ভর্তি করে দেন। পরে রবীন্দ্রনাথের সচিব অনিল চন্দের সঙ্গে বিবাহ হয়। রবীন্দ্রনাথের ছবি আঁকার সহচরী ছিলেন, চমত্কার স্মৃতিকথা লিখেছেন-- যথা 'গুরুদেব'-- তা থেকে রবীন্দ্রনাথের গান সম্পর্কে অনেক তথ্য পাওযা যায়। সুলেখিকা, পুরস্কারপ্রাপ্ত বই (পূর্ণকুম্ভ) লিখেছেন, তা ছাড়া অবনীন্দ্রনাথের স্মৃতিকথার অনুলিখন করেছিলেন।

শরত্কুমার চক্রবর্তী (১৮৭০-১৯৪২):   রবীন্দ্রনাথের প্রথম সন্তান মাধুরীলতার স্বামী, কবি বিহারীলালের চতুর্থ পুত্র। সফল আইন-ব্যবসায়ী ছিলেন, প্রথমে থাকতেন জোড়াসাঁকোতে, পরে স্ত্রীকে নিয়ে কলকাতাতেই ডিহি শ্রীরামপুর রোডে চলে যান। মাধুরীলতার মৃত্যুর পর তিনি মজঃফরপুরে বাড়ি কেনেন, সেখানেই বাগান আর চাষবাস নিয়ে থাকতেন, সেখানেই মারা যান। নিঃসন্তান।

শান্তিদেব ঘোষ (১৯১০-১৯৯৯):   রবীন্দ্রনাথের সহকারী কালীমোহন ঘোষের পুত্র, খ্যাতনামা সম্পাদক সাগরময় ঘোষের ভ্রাতা। একবছর বয়সে শান্তিনিকেতনে আসেন এবং সেখানেই আজীবন ছিলেন। ১৯৩০ সালে শিক্ষক হিসাবে বিশ্বভারতী যোগদান করেন, সঙ্গীতভবনের অধ্যক্ষ ছিলেন দুই দফায় সাত বছর। রবীন্দ্রনাথের শেষ বয়সে তাঁর গানের স্বরলিপি তৈরি করা ও রক্ষণের ভার নিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথের নির্দেশে সিংহল ও বালি দ্বীপে গিয়ে সেখানকার নৃত্যকলা শিখে আসেন এবং শান্তিনিকেতনে নৃত্যশৈলী গঠন, শিক্ষণ ও প্রচারের ভারও মুখ্যত তাঁর উপরেই ন্যস্ত হয়। শান্তিনিকেতনের বহু অনুষ্ঠানে শিল্পী ও ও পরিচালক হিসেবে দেখা যায়। গায়ক, নৃত্যশিল্পী, সুলেখক -- রবীন্দ্রনাথের সঙ্গীতজগৎ ও সঙ্গীতচিন্তার উপর বেশ কয়েকটি প্রামাণ্য বইয়ের প্রণেতা।

শৈলজারঞ্জন মজুমদার (১৯০০-১৯৯২):   কলকাতায় রসায়নে স্নাতক হয়ে ১৯৩২ সালে বিশ্বভারতীতে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। সঙ্গীতপ্রতিভা ছিল, এসরাজ বাজাতে পারতেন, একদিকে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে ও অন্যদিকে রবীন্দ্রনাথ এবং দিনেন্দ্রনাথের কাছে রবীন্দ্রসঙ্গীতে শিক্ষালাভ করেন এবং শেষ পর্যন্ত রসায়ন ছেড়ে পুরোপুরি রবীন্দ্রসঙ্গীত রক্ষণ, শিক্ষণ ও প্রচারে নিজেকে নিয়োগ করেন। রবীন্দ্রনাথের প্রায় দেড়শত গানের স্বরলিপি করেছেন, দিনেন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতন ত্যাগের পর রবীন্দ্রনাথের গানের অন্যতম ভাণ্ডারী বলে গণ্য হতেন, কিছুদিন সঙ্গীতভবনের অধ্যক্ষ ছিলেন। শুদ্ধরূপে রবীন্দ্রসঙ্গীতের সংরক্ষণের প্রচেষ্টায় অগ্রগণ্য। স্মৃতিকথা "যাত্রাপথের আনন্দগান" থেকে রবীন্দ্রনাথের গান সম্বন্ধে অনেক কাহিনী জানা যায়।

শৌরীন্দ্রমোহন ঠাকুর (১৮৪০-১৯১৪):   পাথুরিয়াঘাটা ঠাকুর-পরিবারের হরকুমার ঠাকুরের পুত্র। সঙ্গীতজ্ঞ বলে নাম ছিল, কিছু প্রামাণ্য বইও লিখেছিলেন। নাইটহুড পেয়েছিলেন। Bengal Academy of Music প্রতিষ্ঠা করেন।

সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৫৯-১৯৩৩):   মহর্ষির দ্বিতীয় পুত্র, প্রথম ভারতীয় আইসিএস। পত্নী জ্ঞানদানদিনী দেবী, পুত্র সুরেন্দ্রনাথ, কন্যা ইন্দিরা -- সপরিবার সত্যেন্দ্রনাথ আজীবন রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে অতি ঘনিষ্ঠ ছিলেন। যৌবনে রবীন্দ্রনাথ পশ্চিমভারতে তাঁর কর্মস্থলে থেকেছেন, পরে বিলেতযাত্রাও এঁদেরই সঙ্গে -- রবীন্দ্রনাথের প্রথম যুগের সঙ্গীতপ্রতিভার বিকাশে তার গভীর প্রভাব। বাংলা ও ইংরেজী বই ছাড়াও অনেক ব্রহ্মসঙ্গীতের রচয়িতা।

সরলা দেবী চৌধুরাণী (১৮৭২-১৯৪৫):   মহর্ষির কন্যা স্বর্ণকুমারী দেবী ও জামাতা জানকীনাথ ঘোষালের কন্যা। সঙ্গীতজ্ঞা, সমাজসেবী, সাহিত্যিক। রবীন্দ্রনাথকে বহু দক্ষিণ ভারতীয় গান ও সুর সরবরাহ করেন। একসময়ে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গীতচর্চার সহচরী ছিলেন, ভালো পিয়ানো বাজাতেন, রবীন্দ্রনাথের কিছু গানও হার্মনাইজ করেন। "জীবনের ঝরাপাতা" নামে এক উত্কৃষ্ট আত্মজীবনী আছে। বিবাহ করেন লাহোরবাসী রামভজ দত্ত চৌধুরীকে।

সরোজাসুন্দরী দেবী (সরোজ):   দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের জ্যেষ্ঠা কন্যা।

সাবিত্রী গোবিন্দ কৃষ্ণান (১৯১৪-১৯৯৮):   ১৯২৮ সালে রবীন্দ্রনাথ দাক্ষিণাত্য ভ্রমণকালে মাত্র ১৪ বছর বয়সী সাবিত্রীর গলায় দক্ষিণী গান শুনে মুগ্ধ হন এবং রবীন্দ্রনাথের আমন্ত্রণে সাবিত্রী শান্তিনিকেতন স্কুলের ছাত্রী হিসেবে যোগ দেন। সাবিত্রীর গলায় গান শুনে রবীন্দ্রনাথ তাঁর বেশ কয়েকটি বিখ্যাত দক্ষিণী-ভাঙা গান রচনা করেন। সাবিত্রী দেবী সেসব গানের দুটি রেকর্ডও করেছেন।

সাহানা দেবী (১৮৯৭-১৯৯০):   দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের ভাগিনেয়ী, বিশেষ প্রতিভাময়ী গায়িকা। "ঝুনু" বা "বড়ো ঝুনু" নামে খ্যাত ছিলেন। ছেলেবেলাতেই মাসী অমলা দাশের মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথের সংস্পর্শে আসেন এবং রবীন্দ্রসঙ্গীতের এক প্রধান শিল্পী হয়ে ওঠেন। গান নিয়ে তাঁর কৃতি প্রবাদপ্রতিম -- যথা একনাগাড়ে দেড়শো গান গাওয়া, টেলিফোনে চোদ্দোটি গান তুলে নেওয়া, ইত্যাদি। বিবাহিত জীবন সুখের হয়নি, তাঁর দুঃখের দিনে রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং অনেক সাহায্য করেছিলেন। শেষবয়স কাটান পণ্ডিচেরিতে। স্মৃতিকথা "স্মৃতির খেয়া"-তে রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্পর্কে অনেক তথ্য পাওয়া যায়।

সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৭২-১৯৪০):   সত্যেন্দ্রনাথের জ্যেষ্ঠ পুত্র।

সুশীলা ঠাকুর:   দিনেন্দ্রনাথের মা, পারিবারিক অনুষ্ঠানে গান গেয়েছেন ও অভিনয় করেছেন।

সুশোভন সরকার (১৯০০-১৯৮২):   প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ও অধ্যাপক। ব্রাহ্মসমাজ ঘিরে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে পরিচয় ছিল, তাছাড়া পরে প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশের ভগ্নী ও রবীন্দ্রনাথের প্রিয়পাত্রী রেবার সঙ্গে বিবাহ হয়। এঁদের বিবাহ উত্সবে রবীন্দ্রনাথ দুটি গান উপহার দিয়েছিলেন। "প্রসঙ্গ রবীন্দ্রনাথ" নামে একটি স্বল্পদৈর্ঘ্য কিন্তু সুচিন্তিত বই আছে।

সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৯০১-৭৪):   সুধীন্দ্রনাথের পুত্র। সঙ্গীতজ্ঞ, রবীন্দ্রসঙ্গীতের উপর বহু রচনা আছে। স্ত্রী শ্রীমতী ঠাকুর (হাতিসিং) রবীন্দ্রনৃত্যপারদর্শিনী।

স্বর্ণকুমারী দেবী (১৮৫৬-১৯৩২):   মহর্ষির চতুর্থ কন্যা। সাহিত্য, দেশের কাজ, স্ত্রী শিক্ষা বিস্তার ও স্ত্রী স্বাধীনতা নিয়ে প্রচেষ্টা-- এসবে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। ১৮৮৯ সালে বোম্বাইতে কংগ্রেসের পঞ্চম অধিবেশনে প্রতিনিধি হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন।

হিরণ্ময়ী দেবী (১৮৬৮-১৯২৫):   স্বর্ণকুমারীর কন্যা। সমাজসেবী ও লেখিকা। 'বিধবা শিল্পাশ্রম' প্রতিষ্ঠা করেন। সরলা দেবীর সঙ্গে ভারতী পত্রিকার সহ-সম্পাদনা করেন ১৩০২-৪ বঙ্গাব্দে।

হেমেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৪৪-৮৪):   দেবেন্দ্রনাথের তৃতীয় পুত্র, পরিবারের কনিষ্ঠদের শিক্ষাদানের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রনাথ দুজনেই তাঁর এই কৃতি স্মরণ করেছেন তাঁদের জীবনস্মৃতিতে। নিজের মেয়েদের সঙ্গীতে পারদর্শিনী করে গিয়েছিলেন।