জানলা বন্ধ !LANDSCAPE RECOMMENDED!



রবীন্দ্র-সৃষ্ট তাল


রবীন্দ্রনাথ-সৃষ্ট তালের মধ্যে এইগুলির নাম পাওয়া যায় -- ঝম্পক, ষষ্ঠী, রূপকড়া, নবতাল, একাদশী ও নবপঞ্চ। এছাড়া কিছু তালে চলিত মাত্রাভাগকে একটু আধটু পরিবর্তন করেছেন। এদের মধ্যে ষষ্ঠী ছাড়া অন্য তালগুলি কিন্তু তিনি বিশেষ ব্যবহার করেননি। শান্তিদেব ঘোষ বলছেন, "নতুন তালের অধিকাংশ পরীক্ষামূলক মনোভাবের থেকে উত্পত্তি। স্বতউত্সারিত নয়। যে কারণে পরবর্তী জীবনে সেই সব তালে আর গান রচনা করলেন না। এর মধ্যে দুই-চার মাত্রার তালকেই তিনি কিছুটা সহজ করে নিয়েছিলেন বলে বাকি জীবনে ঐ ছন্দের একাধিক গান পাই।" এদের মধ্যে আবার শুধু রূপকড়া, নবতাল আর একাদশী, এই তিনটি তালের ঠেকা লিখে গেছেন কাঙালীচরণ সেন। অন্যগুলির প্রামাণ্য ঠেকা পাওয়া যায় না। লক্ষণীয় যে রবীন্দ্র-সৃষ্ট তালগুলির কোনোটিতেই ফাঁক বা খালি নেই-- শুধু তালি।

ঝম্পক: পাঁচ মাত্রা, মাত্রাবিভাগ ৩। ২, সাধারণত মধ্য থেকে দ্রুত লয়। উদাহরণ: 'আজি ঝড়ের রাতে' (তবলা, বিলম্বিত-ঘেঁষা মধ্য); 'কোথা বাইরে দূরে' (খোল, মধ্য); 'ঘুমের ঘন গহন হতে' (মৃদঙ্গ, দ্রুত-ঘেঁষা মধ্য)। সুবিনয় রায়-কৃত ঠেকা:
তবলা: I ধিন্ ধিন্ না । ধিন্ না I
মৃদঙ্গ: I ধা দেন্ তা । তেটে ঘেনে I

অর্ধ ঝাঁপ: পাঁচ মাত্রা, ২। ৩, নামেই যা বোঝা যায়, প্রচলিত ঝাঁপতালের অর্ধেক। কর্ণাটী রূপকম্ ও কির্রীট তালের সঙ্গে সাদৃশ্য আছে। উদাহরণ: 'চরণ ধরিতে দিয়ো গো আমারে'। ঠেকা:
তবলা: I ধি না । ধি ধি না I

ষষ্ঠী: ছয় মাত্রা, মাত্রাবিভাগ ২। ৪, লয় বেশীর ভাগই দ্রুত, কখনো মধ্য, কদাচিৎ বিলম্বিত। দক্ষিণ ভারতীয় তাল 'পত্তি'র সঙ্গে মিল আছে। "ষষ্ঠী" নামটি রবীন্দ্র-তিরোভাবের পর রাখা হয়, আগে শুধু 'দুই-চার' তাল নামেই পরিচিত ছিল"-- লিখছেন সুবিনয় রায় । উদাহরণ: 'শ্যামল ছায়া নাই বা গেলে' (তবলা, মধ্য), 'নিদ্রাহারা রাতের এ গান' (খোল, দ্রুত), 'নীলাঞ্জন ছায়া' (তবলা, বিলম্বিত)। সুবিনয় রায়-কৃত ঠেকা:
তবলা (মধ্য) I ধা তেৎ । ধাগে তেটে ধিন্ না I
তবলা (দ্রুত):I ধা গে । ধা গে ধিন্ নাI

কিছু গান আছে যাদের প্রকাশিত তাল দাদরা হলেও ঝোঁক বিচার করলে ষষ্ঠীতেই মানায় বেশী। সুবিনয় রায় তার তালিকা দিয়েছেন: 'আহবান আসিল মহোত্সবে', 'বিদায় যখন চাইবে তুমি', 'ওকি এলো ওকি এলো না'।

৪। ২ ছন্দে (অর্থাৎ উল্টো ষষ্ঠী) একটি গান আছে বিলম্বিত-ঘেঁষা মধ্যলয়ে-- 'হৃদয় আমার প্রকাশ হোলো'। এর তবলার সুবিনয় রায়-কৃত ঠেকা:
I ধা তেটে ধিন্ না । ধাগে তেটে I

রূপকড়া: আট মাত্রা, মাত্রাবিভাগ ৩। ২। ৩, মধ্য লয় কখনো কখনো বিলম্বিত-ঘেঁষা। কর্ণাটী সঙ্গীতে 'সারতাল' এই ছন্দের তাল। এই তালের রবীন্দ্রসঙ্গীতগুলি প্রায় সবই শান্তরসাত্মক, লয় ধীর ও সংযত। উদাহরণ: কত অজানারে জানাইলে (তবলা বিলম্বিত-ঘেঁষা মধ্য), জীবনে যত পূজা (খোল, মধ্য)। কাঙালীচরণ-কৃত ঠেকা:
মৃদঙ্গ I ধাগে তেটে তেটে । তাগে তেটে । কেটে তাগে তেটে I

সুবিনয় রায়-কৃত ঠেকা:
তবলা I ধিন্ ধিন্ ধাগে । তিন্ তাগে । ধিন্ ধিন্ তেটে I
মৃদঙ্গ I ধা দেন তা । তেটে কতা । ঘেনে তেটে ঘেনে I

নবতাল: নয় মাত্রা, মাত্রাবিভাগ ৩। ২। ২। ২, লয় মধ্য ও দ্রুত। উদাহরণ: মাত্র দুটি গান-- 'নিবিড় ঘন আঁধারে', 'প্রেমে প্রাণে গন্ধে', দুটিতেই ধ্রুপদের আভাস আছে। কাঙালীচরণ-কৃত ঠেকা:
মৃদঙ্গ: Iধা দেন্ তা । তেটে কতা। গদি ঘেনে । ধাগে তেটেI

নয় মাত্রার আরো তিনটি গান রবীন্দ্রনাথ রচনা করেছিলেন। এদের 'নবতাল জাতীয়' বলেই গণ্য করা হয়। তার প্রথম দুটির মাত্রাবিভাগ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ও দিনেন্দ্রনাথের মতপার্থক্য ছিল।

প্রথমটি -- 'ব্যাকুল বকুলের ফুলে'
রবীন্দ্রনাথ (৩। ৬):  I ব্যা কু ল । ব কু লে র ফু লে I
দিনেন্দ্রনাথ (৫। ৪):  I ব্যা কু ল ব কু । লে র ফু লে I

দ্বিতীয়টি-- "যে কাঁদনে হিয়া কাঁদিছে'
রবীন্দ্রনাথ(৬। ৩): I যে কাঁ দ নে হি য়া । কাঁ দি ছে I
দিনেন্দ্রনাথ(৩। ৩। ৩): I যে কাঁ দ । নে হি য়া । কাঁ দি ছে I

সুবিনয় রায়ের মতে এ গানটি দিনেন্দ্রনাথ-কৃত ৩। ৩। ৩ সমপদী ছন্দে বিলম্বিত লয়ে গানটি আরো মনোগ্রাহী হয়। তিনি একটা ঠেকার নির্দেশ করেছেন : I ধিন্ ধিন্ না । নাগ্ থুন্ না । তেটে ধিন্ তেটে I

তৃতীয় গানটি 'দুয়ার মোর পথ পাশে' গানে রবীন্দ্রনাথ কোনো মাত্রাবিভাগ দেখান নি , অর্থাৎ সমের তালির পর আর কোনো তালি নেই। কর্ণাটী সঙ্গীতে এর নাম 'বস্তুতাল'।  

দশমাত্রার তাল: ঝাঁপতাল রবীন্দ্রসঙ্গীতে বহু ব্যবহৃত, কিন্তু একটি গানে-- 'দেখা দিয়ে যে চলে গেল'-- তিনি ৫। ৫ মাত্রাবিভাগ ব্যবহার করেছেন। সুবিনয় রায়ের নির্দেশিত ঠেকা ঝাঁপতালেরই:
মৃদঙ্গ: I ধিন্ নাগে তেটে ধিন্ না । তিন তাগে তেটে ধিন্ না I
         দে    খা   দি   য়ে   যে    চ    লে    গে   ল  ও

একাদশী: এগারো মাত্রা, মাত্রাবিভাগ ৩। ২। ২। ৪, মধ্য লয়। একটিই গান, 'দুয়ারে দাও মোরে রাখিয়া'। কাঙালীচরণ-কৃত ঠেকা:
মৃদঙ্গ I ধা দেন তা । তেটে কতা । গদি ঘেনে । ধাগে তেটে তাগে তেটে I

এছাড়া ৩।৪।৪ ভাগে একটি এগারো মাত্রার তালের গান আছে, 'কাঁপিছে দেহলতা থরথর', সুবিনয় রায় একটু ঝোঁক বদল করে ঠেকা দেখিয়েছেন:
মৃদঙ্গ: I ধা দেন্ তা । তেটে কতা গদি ঘেনে । ধাগে তেটে তাগে তেটে I

বারোমাত্রার তাল: ত্রিমাত্রিক একতাল ছন্দে রবীন্দ্রনাথের অনেক গান আছে, কিন্তু শান্তিদেব ঘোষ দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন একটি অনন্য গানে, 'সখী প্রতিদিন হায়' , যেটি দিনেন্দ্রনাথ-কৃত স্বরলিপির বই 'শেফালি'-তে ৬+৬ মাত্রা ভাগে দেখানো আছে।

নবপঞ্চ: আঠারো মাত্রা, মাত্রাবিভাগ ২। ৪। ৪। ৪। ৪, পাঁচটি তালি বলে নাম নব "পঞ্চ"।  একটিই গান 'জননী তোমার করুণ'। সুবিনয় রায়-কৃত ঠেকা:

মৃদঙ্গ:ধা গে ধা গে দেন্ তা কত্ তাগে দেন্ তা তেটে ধা দেন্ তা তেটে কতা গদি ঘেনে
    নী তো০ মা   র০ ক০ রু   ণ০ চ০ র০   খা০ ০০ ০০ নি  


উপরের তালগুলির গানের বা স্বরলিপির বইতে প্রথম প্রকাশের তালিকা দেওয়া হোলো, তাতে দেখা যাবে ১৩১০ থেকে ১৩২৪ সালের মধ্যেই তিনি বেশীর ভাগ তাল সৃষ্টি করেছেন, কেবল ষষ্ঠী তালটি ১৩২৯ সালে।

১৩১০, মোহিত সেন সম্পাদিত কাব্যগ্রন্থ: গভীর রজনী (রূপকড়া), দুয়ারে দাও মোরে (একাদশী), নিবিড় ঘন আঁধারে (নবতাল) ।
১৩২১, গীতালি: হৃদয় আমার প্রকাশ হলো (৪+২)।
১৩২৪, সঙ্গীতের মুক্তি প্রবন্ধ: ৫+৫, ৫+৪, ৩+৪+৪, ৯, ৬+৩ মাত্রার গান।
১৩২৬, শেফালি: সখী প্রতিদিন হায় (৬+৬)।
১৩২৯, নবগীতিকা ১: আমার যদিই বেলা (ষষ্ঠী)।

এছাড়া কিছু প্রচলিত তাল আছে, যেগুলির বিশেষ রূপ রবীন্দ্রসঙ্গীতে ব্যবহার করা হয়। সেগুলি:

সুরফাঁকতাল: দশ মাত্রা, কেবল ৪। ২। ৪ মাত্রাবিভাগই রবীন্দ্রসঙ্গীতে ব্যবহার করা হয়, সবই তালি, কোনো ফাঁক নেই। প্রচলিত তিনটি তাল ও দুটি ফাঁক দেওয়া ২। ২। ২। ২। ২ ভাগটি ব্যবহৃত হয় না। ঠেকা:
মৃদঙ্গ: I ধা ঘেড়ে নাগ্ ধী । ঘেড়ে নাগ্ । গদ্ দী ঘেড়ে নাগ্ I

ধামার: চোদ্দো মাত্রা, ব্যবহার ৩। ২। ২। ৩। ৪, তিনটি তাল, দুটি ফাঁক ( তিনটি তাল একটি ফাঁকের ৫। ২। ৩। ৪ রূপ রবীন্দ্রসঙ্গীতে ব্যবহার হয় না)। ঠেকা:
মৃদঙ্গ: I ক ধি ট । ধি ট । ধা - । গ দি ন । দি ন তা - I

যৎ তাল: রবীন্দ্রনাথের গানে সাত মাত্রার যৎ তালও (চাঁচর তালও বলা হয়) ব্যবহৃত হয়েছে। ঠেকা:
তবলা: I ধা ধিন্ -। ধা ধা ধিন্ - I

আড়াচৌতাল: ২।৪।৪।৪ ভাগ, কোনো ফাঁক নেই। প্রচলিত ছন্দ ২। ২। ২। ২। ২। ২। ২, চারটি তাল, তিনটি ফাঁক রবীন্দ্রনাথ ব্যবহার করেন নি। ঠেকা:
মৃদঙ্গ: I ধিন্ তেরেকেটে । ধিন্ না তু না । কৎ তা তেরেকেটে ধিন্ । না ধিন্ ধিন্ না I


প্রসঙ্গত, ১৯৩১ সালের ৯ই মে একটা চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ ইন্দিরা দেবীকে লিখেছেন, "যে যে তালে আমি গান রচনা করচি তার তালিকা দেব, সেটা চেষ্টা করে দেখিস্--

রূপক, রূপকড়া, ঝাঁপতাল, একতাল, কাওয়ালি, ঠুংরি, আড়াঠেকা, দুই একটা চৌতাল-- দাদরা, যত, কাশ্মীরি খেমটা, একাদশী, নবমী।"

কবি সুরফাঁকতাল, তেওরা, নিজের তৈরি কিছু তাল-- এরকম বেশ কিছু উল্লেখ করতে ভুলে গেছেন। আরো লক্ষ্যণীয় যে ত্রিতাল বা কাহারবার উল্লেখ নেই, অথচ কাওয়ালি এবং ঠুংরি তালের উল্লেখ আছে। এদুটির নিদর্শন পাওয়া যায় তাঁর প্রথম বয়সের অনেক গান ও স্বরলিপিতে। ইন্দিরা দেবী ও শান্তিদেব ঘোষের কাছ থকে জানছি যে সেই সময়ে ত্রিতালকেই কাওয়ালি বলা হোতো। আর শান্তিদেব ঘোষের এক তথ্যবহুল রচনায় দেখা যাচ্ছে যে সেকালে একটি তালেরও নাম ছিলো ঠুংরি। কখনো সেটি ২।২ চারমাত্রার, আবার কখনো ৪।৪ বা ২।২।২।২ আট মাত্রার তাল। এই তালের গানগুলিই পরে কাহারবা তালের ছাপ পেয়েছে বলে শান্তিদেবের বিশ্বাস।

_______________________________
উত্স:  
সুবিনয় রায়, রবীন্দ্রসংগীত সাধনা, এ মুখার্জী, ১৩৮৫।
সুবোধ গঙ্গোপাধ্যায়, রবীন্দ্র-নজরুল বিভাকর, নাথ ব্রাদার্স, ১৯৯৮।
ইন্দুভূষণ রায়, রবীন্দ্রসঙ্গীত পরিচয়, নাথ ব্রাদার্স, ১৪০২।
শান্তিদেব ঘোষ, রবীন্দ্রসঙ্গীত, বিশ্বভারতী, ১৩৭৬।
শান্তিদেব ঘোষ, রবীন্দ্রনাথের গানে ঠুংরির প্রভাব, রবীন্দ্রসঙ্গীত চিন্তা (সুব্রত রুদ্র সম্পাদিত), প্রতিভাস, ১৯৯৩।